আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পররাষ্ট্রনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছেন। এতদিন ধরে ভারত এবং তার রাশিয়া থেকে তেল কেনার সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করছিলেন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি তার মনোযোগ ঘুরেছে চীনের দিকে। এখন তিনি ন্যাটো সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চীনের পণ্যের ওপর ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে। ট্রাম্পের এই নতুন কৌশল আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ট্রাম্পের বক্তব্য এবং তার কৌশল
ট্রুথ সোশ্যাল-এ একটি দীর্ঘ পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন যে, রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করতে এবং ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ করতে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর উচিত চীনের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করা। তার দাবি, চীন রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ তেল কিনছে, যা রাশিয়াকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অর্থনৈতিক শক্তি যোগাচ্ছে। তিনি মনে করেন, যদি ন্যাটোর দেশগুলো সম্মিলিতভাবে চীনের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে, তাহলে চীনের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে এবং এর ফলে রাশিয়াকে দেওয়া চীনের সমর্থন দুর্বল হবে। ট্রাম্প আরও বলেন যে, আমেরিকা রাশিয়ার ওপর বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে প্রস্তুত, তবে ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকেও রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করতে হবে।
এই মন্তব্যের মাধ্যমে ট্রাম্প দুটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতে চেয়েছেন: প্রথমত, তিনি তার সমালোচনার লক্ষ্য ভারত থেকে সরিয়ে চীনের দিকে নিয়ে এসেছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি ন্যাটো জোটের মধ্যে ঐক্যের উপর জোর দিয়েছেন, যেখানে সদস্য দেশগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে।
ভারত প্রসঙ্গ এবং সুর নরম হওয়ার কারণ
কিছুদিন আগেও ভারতের রাশিয়া থেকে তেল কেনা নিয়ে ট্রাম্পের কঠোর মন্তব্য ছিল। তিনি ভারতকে শুল্ক আরোপের হুমকিও দিয়েছিলেন। তবে সম্প্রতি তিনি তার সুর নরম করেছেন। একটি সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প স্বীকার করেছেন যে, ভারতের ওপর শুল্ক আরোপ করা সহজ কাজ নয়, কারণ এতে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ভারত রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা হলেও, ইউরোপের দেশগুলোও কম তেল কেনে না।
এই পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় কারণই থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাম্প সম্ভবত আসন্ন নির্বাচনের আগে ভারতের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চান না। ভারতের বিশাল বাজার এবং ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে আমেরিকা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।
চীনের প্রতিক্রিয়া এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের আহ্বানে চীন দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বেজিং-এর পক্ষ থেকে সাফ জানানো হয়েছে যে, চীন কোনো যুদ্ধ করে না বা যুদ্ধের পরিকল্পনাও করে না। চীনের এই সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া ইঙ্গিত দেয় যে, তারা আমেরিকার এই ধরনের চাপকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা ট্রাম্পের এই নতুন কৌশলকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন।
- ড. অনিতা গুপ্তা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ: “ট্রাম্পের এই প্রস্তাব অর্থনৈতিকভাবে একটি ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। চীনের ওপর ৫০-১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলে শুধু চীন নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব পড়বে। অনেক মার্কিন কোম্পানি চীনের ওপর নির্ভরশীল, তাই এমন শুল্ক তাদের ব্যবসায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটি একটি রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশল হতে পারে, কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন।”
- প্রফেসর রোহন রায়, ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক: “ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের পেছনে একটি স্পষ্ট ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। তিনি রাশিয়াকে দুর্বল করতে চীনকে ব্যবহার করতে চাইছেন। একই সাথে তিনি ন্যাটো দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে পারেন, কারণ সব দেশই চীনের ওপর সমানভাবে নির্ভরশীল নয়।”
ট্রাম্পের অতীতের সাফল্য এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ট্রাম্প তার বক্তব্যে নিজের অতীতের সফলতার কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে, তিনি সাতটি যুদ্ধ সমাধান করেছেন এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার উত্তেজনা সহ অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করেছেন। যদিও তার এই দাবিগুলো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তিনি নিজেকে একজন সফল সমস্যা সমাধানকারী হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছেন।
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ যদি সফল হয়, তাহলে তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। তবে চীনের শক্তিশালী অর্থনীতি এবং অন্যান্য দেশগুলোর ওপর তার নির্ভরশীলতা বিবেচনা করলে এই প্রস্তাব কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
0 Comments