একটা সময় ছিল যখন সিনেমার পর্দা আলোকিত হতো প্রতিভার স্ফুলিঙ্গে। নায়িকারা আসতেন, তাদের চোখে স্বপ্ন, কণ্ঠে আবেগ আর অভিনয়ে সততা নিয়ে। তারা চরিত্র হয়ে উঠতেন, মানুষের হাসিকান্না, আনন্দ-বেদনার অংশীদার হতেন। আমরা দেখতাম সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, শাবানা আজমীকে, হেমা মালিনী, মীনা কুমারী। তাদের সৌন্দর্য ছিল সহজাত, যা তাদের অভিনয়কে আরও পূর্ণতা দিত। তাদের রূপ বা শরীরের গঠন নয়, বরং তাদের আবেগ, অভিব্যক্তি আর শিল্পবোধই ছিল মূল পরিচয়।
দর্শকরা তাদের ভালোবাসতেন কারণ তারা তাদের নিজেদের জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেতেন এই অভিনেত্রীদের মধ্যে। সেই ভালোবাসা ছিল নির্ভেজাল, গভীর এবং হৃদয় থেকে উৎসারিত।
কিন্তু সময় বদলেছে। এখনকার সিনেমায় যেন ভিন্ন এক প্রতিযোগিতার সুর। শিল্প বা প্রতিভা নয়, বরং শারীরিক সৌন্দর্য এবং ফিগার প্রদর্শনী যেন মূল যোগ্যতা। যেন একটি নির্দিষ্ট মাপের শরীর না থাকলে আর পর্দায় জায়গা হয় না। নায়িকারা যেন পণ্যে পরিণত হয়েছেন, যাদের মূল্য তাদের পোশাকের দৈর্ঘ্য বা বডি শেপের ওপর নির্ভর করে। তাদের অভিনয় দক্ষতা, তাদের শিল্পবোধ, বা তাদের শিক্ষা যেন এই নতুন মানদণ্ডের কাছে গৌণ হয়ে পড়েছে।
আজকের সমাজে এই পরিবর্তন শুধু সিনেমার পর্দায় সীমাবদ্ধ নেই, এটি আমাদের সমাজের গভীর অসুখের প্রতিচ্ছবি। যখন একজন অভিনেত্রী তার কাজের চেয়ে তার শরীর নিয়ে বেশি আলোচনায় আসেন, তখন বোঝা যায় আমরা কোথায় দাঁড়িয়েছি। একজন লেখক, একজন কবি, একজন শিল্পী তার সৃষ্টির মাধ্যমে পরিচিত হন। তবে একজন অভিনেত্রী কি শুধুই তার শরীরের মাধ্যমে পরিচিত হবেন? এটি সেই সময়ের শিল্পের প্রতি অবমাননা, যখন শিল্পীরা কেবল তাদের শিল্পের জোরেই চিরন্তন হয়ে থাকতেন।
এই পরিবর্তন কি আমাদের সমাজের মানসিক দীনতার লক্ষণ নয়? আমরা কি শিল্পকে তার সঠিক মর্যাদা দিতে ভুলে যাচ্ছি? যখন একজন অভিনেত্রী তার সৃজনশীলতাকে বাদ দিয়ে নিজেকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে বাধ্য হন, তখন কি আমরা সমাজের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এই প্রবণতাকে প্রশ্ন করব না? আমাদের উচিত এই বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হওয়া এবং শিল্পের প্রকৃত মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা।
আসুন, আমরা আমাদের দৃষ্টিকে আরও গভীর করি। আমরা চাই এমন এক শিল্প মাধ্যম, যেখানে মানুষের আবেগ এবং মেধা সর্বোচ্চ স্থান পাবে, যেখানে শরীর নয়, বরং শিল্পই হবে আসল পরিচয়।
0 Comments